Monday, August 05, 2013

জীবনে একবার দেখা হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ


মাকসুদুল হক 

১৯৮৯ এর এক দুপুর | দিলকুশায় আমার অফিসে কাজের ঝামেলায় আছি,এর ভেতর এক কলিগ এসে বললো, ৭জন ছেলে এসেছে আমার সাথে দেখা করতে | জানতে চেলাম কি বিষয় | বললো ফিডব্যাক কে কৃষি কলেজে একটা কনসার্ট এ আমন্ত্রণ জানাতে চায় ছাত্র লিগ | ফিডব্যাকের গায়ক ছাড়া ব্যবসায়িক লেনদেন আমি করতাম তাই ওদের হ্যালো বলে বসতে বললাম আর ১৫ মিনিট পর কাজ সেরে বিস্তারিত খোজখবর নিলাম |

সবি ঠিক লাগলো তবে টাকা এত কম যে আমাদের সন্মানী তো দুরের কথা, সাউন্ড সিস্তামের ভাড়াও তাতে কভার হবেনা| ছেলেগুলো প্রায় কান্নার কাছাকাছি - হাত ধরে বলে 'মাকসুদ ভাই একটু ট্রাই করেন' | আমি পরদিন যোগাযোগ করতে বলে সন্ধায় দলনেতা বাবু কে এলভিস ষ্টুডিওতে বিষয়টা জানালাম | বাজেটের অবস্থা বেগতিক - বাবু এক কথায় বললো 'দোস্তো ইম্পসিবেল - না বলে দেও কারণ এত কম টাকায় ছাত্র লীগের কনসার্ট করলে অন্য সংগঠনদের না করতে পারবা না' | কথার যৌক্তিকতা ছাড়াও ফিডব্যাক তখন যন্ত্রপাতির কেনার ঋণে জর্জরিত| তার উপর পলিটিকাল শো - মারামারি লেগেই থাকে |

পরদিন শুক্রবার | বাসায় এলভিস ষ্টুডিওর সত্তাধিকারী জাহাঙ্গীর আমাকে ফোনে করে জানালো - একজন আওরঙ্গ নামের লোক আমাকে খুজছে | জাহাঙ্গীরের গলায় খুবই আতঙ্কের ছাপ, বললো 'দোস্তো এইটা ওই 'ভয়ানক সন্ত্রাসী' আওরঙ্গ মনে হচ্ছে, সাবধানে বিষয় তা হ্যান্ডেল করিস' | আমি বললাম 'ধুর ...আওরঙ্গর নাম ভাঙিয়ে অনেকেই চাঁদাবাজি করছে - আওরঙ্গ তো কলকাতায় গাঢাকা দিয়ে আছে অনেকদিন হলো' |

জবাবে জাহাঙ্গীর বললো, 'আমি শুনসি সে নাকি গোপনে দেশে ফিরেছে - সো তুই যা করিস ক্যার্ফুলি করিস আর মাথা ঠান্ডা রাখিস'| আমি বিষয়টা ভুলে গেলাম বললে ভুল হবে - পাত্তাই দিলাম না |

এর পরেরদিন সকাল ৯:৩০ অফিস পৌছে দেখি ওই ৭টা ছেলে লাউঞ্জে বসে আছে | সালাম ঠুকে একজন এসে বললো 'বস - লিদেরের চিরকুটটা পরেন' | একটু হতবাক হয়েই হাতে নিলাম - অত্যন্ত সুন্দর হাতের লেখা একটা চিরকুট :

"আমার সুপ্রিয় গায়ক মাকসুদ, 
ছেলদের সাথে তুমি কষ্ট করে চলে আসো ভাই..একটু চা নাস্তা করে যাও| 
ইতি তোমার 
আওরঙ্গ দা "

ভয়ে কেমন জানি দেহে একটা কাপুনি অনুভব করলাম | কতোনা এই 'ভয়ংকর সন্ত্রাসীর' কথা শুনেছি, পত্রিকায় পরেছি - আর আজ উনি আমাকে 'চা নাস্তার' আমন্ত্রণ দিচ্ছে ?

জানতে চেলাম 'কোথায় যেতে হবে - উনি তো এখনো আত্মগোপন অবস্থা আছেন তাই না' - ছেলে গুলো মাথা নিচ করে নিরুত্তর রইলো | ওদের আস্বস্ত করতে বললাম 'ভাই আমি উনার সাথে দেখা করতে ভয় পাচ্ছি না - কিন্তু উনারে তো করা নজরদারির উপর ঈরশাদ সরকার রেখেছে নিশ্চয়? আমি এরেস্ট হলে গান বাজনা চাকরি আমার কিন্তু সব শেষ - সন্ত্রাসীর খাতায় ও আমার নাম উঠবে' |

ছেলেটা কন্ফিদেন্ত্লি বললো - 'লিডার কোথায় আছেন এইটা তো বলা নিষেদ তবে ইনশাল্লাহ আপনার কোনো সমস্যা হবে না - আমরা আছি আপনার সাথে' |

ভিশন রকম দোটানায় পরে গেলাম ....আমার পেট বললো .... 'না যাব না', কিন্তু মুখ বললো - 'চলো যাই' | বেরুনোর আগে বাবুকে ফোন করে বিষয়টা জানালাম | বাবু চিন্তায় পরে গেলো | বললো 'ও মাই গড - দি গাই ইজ ফর রিয়াল'? আমি বললাম 'ইয়েস'! উত্তরে বাবু বললো, 'ম্যাক - বেস্ট অফ লাক - তুমি ফিরেই আমাকে কল দিও এন্ড বি কেয়ারফুল ' |

ছেলেগুলা কে আমি বললাম আমার গাড়িতে উঠতে | জবাবে ওরা বললো 'বস আপনার ড্রাইভারকে বলেন গাড়ি নিয়ে আমাদের ফলো করুক, আপনি আমাদের সাথে উঠেন, আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের' |

তাই হলো | আমি বেবি টেক্সীতে উঠলাম - আমার দুপাশে কোমরে অস্ত্রধারী দুই যুবক | সামনে পেছনে আরো ২ টা বেবি টেক্সী - মত ৯-১০ জন আমাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে আওরঙ্গদার কাছে | কিন্তু কোথায় যাচ্ছি ত়া কেউ কিছুই বলছে না | আমিও আর চাপাচাপি করলাম না |

কিছুক্ষণ পরে দেখি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনের সামনে আমরা উপস্থিত| এক টানে বেবি টেক্সী ঢুকলো বাসার বাউন্ডারির ভেতর | আমাকে একটা রুম এ বসিয়ে ছেলেরা চলে গেলো |একা - এই প্রথম আমার জীবনে আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় | তখনও তা মিউজিয়াম হয়ে উঠেনি | কেমন জানি ভুতরে পরিবেশ - ওয়াল এ ঝুলছে ৭ই মার্চ এর ছবি | মনটা খুবই ভারী হয়ে উঠলো | এর ভেতরে ছেলেরা আসে, উকি দিয়ে চলে যাই - আর বলে 'বস একটু থাকেন - লিডার আসছেন অল্পক্ষণের ভেতরে' | বসেই থাকলাম একা - তারপর হঠাত ছেলেরা এসে - ভেতরে আরেকটা রুমে নিয়ে আমাকে বসালো | জানালা সব বন্ধ - টিউব লাইট জলছে |

১০ মিনিটের মাথায় সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা অবিকল একেবারে বাংলা সিনেমার নায়ক উজ্জল ভাই মতো দেখতে এক লোক এসে হাত বাড়িয়ে বললো 'মাকসুদ আমি তোমার আওরঙ্গদা ' | হাতে হাত রাখতেই বুকে জড়িয়ে ধরে বললো 'কেমন আছ ভাই? তোমার নাম, ডাক গান আমি সবি জেনেছি ও শুনেছি ইতোমধ্যে' | এটা সেটা অনেক কিছুই আলাপ করলাম - আর ৩২ নম্বর উনি আছেন একথা অকপটে জানালেন - তবে সব সময় থাকেন না | 'টিকটিকির উত্পাত বেশি দেখলে অন্যত্র সরে যাই মাঝেমাঝে' - বলে মৃদু হাসলেন |

সিংগারা, চা ও পেস্ট্রি খেলাম এবং দুপুরে খেয়ে যাবার জন্য জোর অনুরোধ করলেন | অফিস পালিয়ে দেখা করতে এসেছি বলাতে বললো, 'আচ্ছা ঠিক আছে' | ছেলেদের রুম থেকে বেরিয়ে যাবার ইশারা করে - দরজা বন্ধ করলেন |

এপর পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে চাপিয়ে দিয়ে বললো, 'ভাই সংগঠন তোমার, দেশ তোমার আর আমি তোমার বড়ভাই - বড্ড বিপদে আছি যা তুমি ভালো জানো | টাকা পয়সা একেবারে নাই কিন্তু কৃষি কলেজ এর পর্ষদের নির্বাচনে আমাদের জয় শুনিশিত - তবে ছাত্রদের একটাই ডিমান্ড - ওরা ফিডব্যাক কে চায় প্রজেকশন সন্ধার মিটিঙে | ভাই এটা প্রেস্টিজ ইসু, তুমি বুঝতে পারছ আশা করি | তোমাদের যেই সন্মানী আমি ত়া দিতে পারবো না - কিন্তু আমাকে হেল্প করো - আমি কেবলি তোমাদের বড় ভাই না - আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি' |

চোখের দিকে চোখ রেখে এমন ভাবে 'প্লিজ' বললেন যে আমি এক কথাই রাজি হয়ে গেলাম | আবার জড়িয়ে ধরে ছেলেদের বললো 'আমি বলসিলাম না মাকসুদ আমার কথা রাখবে' | চতুরদিকে ছেলেদের আনন্দের যেন বন্যা বয়ে গেলো, হাততালি এবং 'থানক ইউ বস' বলতে বলতে - আবার একই কায়দায় বেবি টেক্সিতে আমাকে অফিসে পৌছানো হলো |

পরদিন রোববার - কনসার্ট শেষ হবার পর আওরঙ্গ দার সাথে দেখা করতে যাবার কথা ছিলো| তবে উনি সেদিন দুপুর থেকে আবার গাঢাকা দিয়েছেন এই খবর পেলাম | এর পর আর আওরঙ্গদার সাথে দেখা হলো না |

হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ গত শনিবার এক মর্মান্তিকসড়ক দুর্ঘটনায় মুন্সীগঞ্জে মারা যান | ইন্নালিলাহে.......রজেঊন

0 Comments:

Post a Comment

<< Home